সেই কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার কাজ। ঠুকঠাক ধুপধাপ শব্দে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষের প্রতিদিনই জীবিকার তাগিদে এমন কর্মে মগ...
সেই কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার কাজ। ঠুকঠাক ধুপধাপ শব্দে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষের প্রতিদিনই জীবিকার তাগিদে এমন কর্মে মগ্ন থাকতে হয় সারাক্ষণ। এমন দৃশ্য চোখে পড়ে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি পৌরসভা শহরের পাঁচমাথা হতে স্টেশন সড়কের পাঁচবিবি লাল বিহারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্টেশন পর্যন্ত কুলিপট্টি এলাকায়। এই সড়কে চলাচলকারী পথচারীদের কানে রাস্তার দুপাশ থেকে ভেসে আসে এমন শব্দ । এ শব্দ নিছক একটি শব্দ নয়, এটি একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিত্যদিনের জীবন সংগ্রামের। এটি পাঁচবিবি পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের অর্ন্তভূক্ত।
এই কলোনীতে বসবাসকারীরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অনুগত। যাদের সকলেই ভূমিহীন দরিদ্র। এদের আদি পুরুষেরা বৃটিশ শাসনামলের শেষ দিকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে পাঁচবিবি স্টেশনে কুলি শ্রমিকের কাজ করতো। কুলি শ্রমিকের কাজ শেষে নিজেরা থাকার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রেলওয়ের পাশেই বসতি গড়ে তোলেন। শুরুতে গুটি কয়েক পরিবার হলেও এখন তা বেড়ে প্রায় ৮৬ টি পরিবার হয়েছে। এরা পরিবার পরিজন নিয়ে গাদাগাদি করে বাস করে টিনের ছাপড়ার ছোট ছোট ঘরে । বর্তমানে এলাকাটি কুলিপট্টি বা তুড়িপট্টি নামেও পরিচিত।
মূলত এদের আদি পেশা কুলিগীরি হলেও এখন সড়ক পথে ট্রেনে মালামাল পরিবহন কমে যাওয়ায় পাঁচবিবি রেলওয়ে স্টেশনে আগের মত আর মালামাল উঠা নামা করে না। এতে করে অধিকাংশ কুলি কর্মহীন হয়ে পরে। এ অবস্থায় জীবন ধারনের জন্য অনেকেই পেশা বদলিয়ে অটো,রিক্সা, ভান চালিয়ে, রং মিস্ত্রি সহ বিভিন্ন কাজ করে। বাঁচার সংগ্রামে এদের অনেক পরিবারের মহিলারা বেছে নেয় ইট ভেঙে খোয়া তৈরির কাজ । শুরুতে কয়েকজন হলেও এখন নানা বয়সী পুরুষ মহিলা মিলে প্রায় ৭০/৭২ টি পরিবার একাজে জড়িয়ে পড়েছে। আগে পুরাতন ভবনের পরিত্যক্ত ইট কিনে খোয়া করে বিক্রি করলেও এখন বিভিন্ন ইটভাটা থেকে টুকরো ইট কিনে খোয়া তৈরি করছে তারা। এসব খোয়া বিভিন্ন মানের। স্বচ্ছল ও নিম্ন আয়ের সব শ্রেনীর মানুষ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন কিনে এসব খোয়া। ছোট ছোট প্রতি টুকরি ডালি খোয়ার দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা । এ আয় দিয়ে তারা পরিবারের ভরণ পোষন, ঋনের কিস্তি আর বাচ্চাদের লিখা পড়ার খরচ চালায় । তবে স্বচ্ছলতা নেই কারো। তারপরও জীবন থেমে নেই। নেই শিক্ষার আলো।
তবে ইদানিং কিছু সচেতন মা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠায়। নেই কোন শৌচাগার। এমন সংগ্রামী জীবন নিয়ে তাদের রয়েছে হতাশার অভিব্যক্তি । বিধবা সারথী রানি (৭৮), গৃহবধূ মিনু ( ৪০), রং মিস্ত্রি সুমনের স্ত্রী ঝুমুর ( ৩০), দেবদাস (৪৫), বুলো ( ৫২ ), গৌড় (৭৫), মিনতি (৬৫) ও মরিয়ম (৭০) সকলে প্রায় একই কথা বলেন। তারা বলেন আগে ভাটায় ইটের দাম কম ছিল এখন বেশি হওয়াতে আগের মত লাভ হয় না। তারপরও জীবনের প্রয়োজনে এসব করতে হচ্ছে। এদিকে স্কুলের সীমানা প্রাচীরের বাইরে যারা খোয়া ভাঙ্গে মাঝে মাঝে তাদেরকে কর্তৃপক্ষ ঐ স্থান থেকে সরে যেত বলে । কিন্তু তাদের যাবার জায়গা নেই। ভোটের সময় এদের কদর আর আশ্বাস থাকলেও অন্য সময় থাকে অবহলায়। এদের নেই কোন সংগঠন। এ পেশায় জড়িতরা নিজের পরিবর্থনে চায় সরকারি সহায়তা।
সজল কুমার দাস।

কোন মন্তব্য নেই